দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধিঃ
দুর্নীতির মহা উৎসবে মেতে অনিয়মের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সানন্দবাড়ী ইসলামিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ আকন্দ ।
মাদ্রাসায় যোগদানের পর থেকেই তিনি একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন। অনুগত শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সন্তুষ্ট করে গড়ে তোলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। একের পর এক মনগড়া সিদ্ধান্ত, স্বেচ্ছাচারিতা, অদূরদর্শিতা ও নানা অনিয়মের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন তিনি। শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে নিজ পকেটের মানোন্নয়নের ব্যস্ত থাকেন বলে ছাত্র/ছাত্র, শিক্ষকমন্ডলী ও অভিভাবকগন অভিযোগ তোলেন।
সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা জানান, উপজেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হলেও এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ যেন শেষ কথা।
নিয়োগ বাণিজ্য, রসিদ ছাড়াই অর্থ আদায়, বাজারস্থ মাদ্রাসার জমি বন্ধক দিয়ে নিজের পকেট ভর্তি করা,বেতন খুলে দেয়ার কথা বলে টাকা আত্মসাৎ, এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশকৃত দুই জন সহকারী শিক্ষকের কাছে দুই লক্ষাধিক টাকা চাঁদা দাবী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন স্কেল বাড়ানোর নামে শিক্ষকদের টাকা হাতানোসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
অধ্যক্ষের এ দুর্নীতি-অনিয়ম রোধে যেন কোন দায় নেই মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
গত আগস্ট মাসে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষিকা, ছাত্র- ছাত্রী ও বিদ্যুৎসাহী এবং দাতা সদস্যসহ অনেকেই । এর পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার শেখ জাহিদ হাসান প্রিন্স বিষয়টি আমলে নিয়ে সরেজমিনে তদন্তে আসে।
প্রাথমিক তদন্ত শেষে এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গুলো গভীর ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। দ্রুতই তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
নিয়োগ বাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতি-
অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পরই অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ
মোটা অংকের বিনিময়ে তাঁর নিজ এলাকার পরিচিত বা আত্নীয় স্বজনদের নিরাপত্তা কর্মী, আয়া ও হিসাব সহকারী পদে নিয়োগ দিয়েছেন অথচ সেই পোস্ট গুলোতে নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল স্থানীয় লোকজন। উপস্থিত লোকজনের মৌখিক ভাষ্যমতে জানা যায়, তৎকালীন এই তিন পদে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক টাকারও বেশি নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন তিনি।
এছাড়াও, সাম্প্রতিক বছর কয়েক আগে অফিস সহকারী পদে ফুলমিয়া নামে ব্যক্তি থেকে ১০ লক্ষাধিক ও আফরোজা নামে শিক্ষকের কাছ থেকে ১২ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিলেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি নিয়োগ ।
আব্দুর রশিদের রসিদ ছাড়াই অর্থ আদায়-
একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবক অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা, রেজিষ্ট্রেশন ও বিবিধ খরচের নামে রসিদ ছাড়াই টাকা উঠিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। মাদ্রাসার নাম করে একটি সাদা কাগজে এসব ফি বাবদ টাকা উঠিয়ে নেন অধ্যক্ষ। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়ার সময় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এগুলো কখনোই প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে জমা হয়নি।
গত ২৭ আগস্ট (মঙ্গলবার) সরেজমিনে মাদ্রাসা গিয়ে দেখা যায়, রশিদ ছাড়াই ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের রেজিষ্ট্রেশন ফি নেয়া হচ্ছে। অথচ ২দিন আগেই মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা উপজেলার সকল প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা করেছেন যেন রশিদ ছাড়া কোন আয় ব্যয় করা না হয়।
রশিদ ছাড়া আয়-ব্যয়ের কারণ জানতে চাইলে অফিস কর্মচারীরা কোন উত্তর দিতে পারেননি, সাংবাদিক দেখে পুরাতন রশিদ বই বের করে শিক্ষার্থীদের রশিদ দেয়া শুরু করে।
বেতন স্কেল বাড়ানো নামে টাকা উত্তোলন –
ভুক্তভোগী প্রভাষক আকরাম হোসেন বলেন, ‘‘উচ্চতর স্কেলের আবেদনে টাকা ছাড়া স্বাক্ষর দেন না অধ্যক্ষ। বেতন স্কেল বাড়ানোর কথা বলে চলতি বছরে কয়েক ধাপে মোট ৪৬ হাজার টাকা নিয়েছেন অধ্যক্ষ।
আমি ছাড়াও সে সময় তিনি আরও কয়েক জন শিক্ষকের কাছ থেকে নিয়েছেন হাজার হাজার টাকা। কিন্তু বয়জৈষ্টতা বিবেচনা না করে তার আপন ছোট ভাইকে দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ।
উপজেলা প্রশাসনের পদক্ষেপ-
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আসায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষিকা, ছাত্র ছাত্রী ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীগণ ।
এই বিষয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং মাদ্রাসার সভাপতি বলেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনের সম্মানের বিষয়টিও জড়িত।
অভিযুক্ত অধ্যক্ষ যা বলেন
নিয়োগের ব্যাপারে ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে ১সেপ্টেম্বর (রবিবার) অধ্যক্ষ আব্দুর রশিদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,হ্যাঁ সবগুলোই বিধিসম্মত করা হয়েছে, অনিয়ম করা হয়নি আর বিধি সম্মত না হলে সরকার বিল দিত না।
নিয়োগ দেয়া বাবদ প্রার্থীদের কাছ থেকে কত টাকা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,খরচ বাবদ যা হয় তাই নেয়া হয়েছে, এইলা কি বলার অপেক্ষা রাখে.! এইলা বলার দরকার আছে..! এটাতো বলার অপেক্ষা রাখে না..!
মাদ্রাসার যাবতীয় আয়-ব্যয়ের ভাউচার রশিদ আছে কিনা দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে বাধ্য নন বলেও জানান
আজ ১ সেপ্টেম্বর (রবিবার) সকালে সরেজমিনে মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ মাদ্রাসায় উপস্থিত নেই। উপস্থিতি হাজিরা খাতা চেক করলে দেখা যায় তিনি গত আগস্ট মাস পুরোপুরি প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয় নি। তাৎক্ষণিক সময়ে অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন ২৭,২৮,২৯ আগস্ট পর্যন্ত আমি পারিবারিক সমস্যার কারনে ছুটিতে আছি। কার কাছ থেকে ছুটি নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি/ ইউএনও স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছেন।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও শেখ জাহিদ হাসান প্রিন্সের কাছে অধ্যক্ষের ছুটির বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি জানান ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ আকন্দকে কোন ছুটি দেন নি ।
Leave a Reply